বিমা কোম্পানি তার নিজের পণ্য বিক্রি করবে, এটাই স্বাভাবিক। করছেও তা-ই। তবে ব্যাংকও বিমা পণ্য বিক্রি করবে—এমন চর্চাও প্রায় সারা বিশ্বেই চালু আছে অনেক আগে থেকেই। ব্যবস্থাটির নাম ‘ব্যাংকাস্যুরেন্স’। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে। এখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে করতেই কেটে গেছে বছর দশেক। অবশেষে এ-সংক্রান্ত একটা কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতি আছে।
ব্যাংকাস্যুরেন্স বাস্তবায়িত হবে মূলত দেশের ব্যাংকগুলোর শাখার মাধ্যমে। আরেক অর্থে বলতে গেলে বিমা কোম্পানির করপোরেট এজেন্ট বা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমা খাতের প্রতি আস্থা-অনাস্থার দোলাচলে থাকেন সাধারণ মানুষ। ব্যাংকাস্যুরেন্স যেহেতু ব্যাংকের মাধ্যমে হবে, সেহেতু এটি হতে পারে মানুষের ভরসার জায়গা। এ জন্য গ্রাহকদের বিমা কোম্পানিতে যেতে হবে না, ব্যাংকের শাখায় গেলেই চলবে। অর্থাৎ ব্যাংক তার নিজের গ্রাহকের কাছে ব্যাংকিং পণ্যের পাশাপাশি বিমা পণ্যও বিক্রি করবে। পণ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পেনশন, স্বাস্থ্য, দুর্ঘটনা, দেনমোহর, শিক্ষা, ওমরাহ হজ ইত্যাদি।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) যৌথভাবে ব্যাংকাস্যুরেন্স-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। চালু হওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার। সূত্র বলছে, আজ ১ মার্চ বুধবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার কথা থাকলেও কিছু কাজ বাকি থাকায় আরেকটু সময় নেওয়া হচ্ছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই ব্যাংকাস্যুরেন্সের এজেন্ট হতে পারবে। সে জন্য বিমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে হবে তাদের। তবে কোনো ব্যাংকাস্যুরেন্স এজেন্ট তিনটির বেশি বিমা কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে না। এ জন্য বিমা কোম্পানিকে আইডিআরএ এবং ব্যাংকাস্যুরেন্স এজেন্টকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে।
আইডিআরএ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকাস্যুরেন্স কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে আইডিআরএ বাংলায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ইংরেজিতে কিছু দিকনির্দেশনা তৈরি করেছে। অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল দুটোকে মিলিয়ে বাংলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই কাজ চলছে এখন। চলতি মার্চ মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ বিষয়ে দুটি আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
জানা গেছে, ব্যাংকাস্যুরেন্স একটি ফরাসি শব্দ। ১৯৮০ সালের দিকে ফ্রান্স ও স্পেনে প্রথম এটি চালু হয়। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে জীবনবিমা পলিসি বিক্রি হয়। এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে এটি। নিকটতম প্রতিবেশী ভারতে এটি চালু হয় প্রায় তিন যুগ আগে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাও এতে সফল হয়েছে। অথচ ৬০টি ব্যাংক ও ৭৯টি বিমা কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।
ব্যাংকাস্যুরেন্স নিয়ে ১৩টি দেশে ফাউন্ডেশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব লাইফ অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড (এফএএলআইএ) পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়, ব্যাংকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ৭৯ শতাংশ পলিসি বিক্রি হয় তুরস্কে। ভারতে এ হার ২০ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিমার তুলনায় ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা বেশি থাকায় ব্যাংকাস্যুরেন্সের আওতায় বিমা পলিসি কেনার প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান হাসিনা শেখ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকাস্যুরেন্স পুরো বিমা খাতকে উজ্জীবিত করবে। এটা চালু হলে বিমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম সংগ্রহের খরচ কমবে। আবার বাড়তি খরচ ছাড়াই বিমা পণ্য বিক্রি করতে পারবে ব্যাংক। অন্যদিকে এ খাতে গ্রাহক বাড়বে।
দেশে ব্যাংকের মোট শাখা এখন ১০ হাজারের বেশি, এ তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের। আর বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ৯ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী গত সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে জানান, দেশের এক কোটি মানুষ বিমার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মানে ১৬ থেকে ১৭ কোটি মানুষ এখনো বিমার বাইরে রয়ে গেছে।
দেশে যেহেতু ব্যাংকাস্যুরেন্স নেই, সেহেতু এটি নিয়ে কোনো গবেষণাও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) শিক্ষক মোহাম্মদ জেড মামুন একবার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। তাতে উঠে আসে যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশের ব্যাংকগুলো নিজস্ব পণ্যের পাশাপাশি বিমা পণ্যও বিক্রি করে। বাংলাদেশেও এর বিশাল সম্ভাবনা আছে। ব্যাংকের যেহেতু বড় একটা গ্রাহকশ্রেণি রয়েছে, সেহেতু নিজেদের গ্রাহকদের মধ্যেই তারা বিমা পণ্য বিক্রি করতে পারবে। করপোরেট গ্রাহক বেশি ও কোম্পানির বেতন হয় এমন ব্যাংকগুলো শুরুর দিকে বিমা পণ্য বিক্রিতে এগিয়ে আসতে পারে।
বিমা কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের (বিআইএফ) সভাপতি বি এম ইউসুফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় বিমা খাতের যে ক্ষতিটা হয়েছে, তার দ্বিগুণ পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে। আমরা সবাই এটি চালুর অপেক্ষায় আছি।’